শিল্পাচার্য এস. এম. সুলতান: বাংলার প্রাণের রঙে অমর এক কিংবদন্তি
বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসে যে কজন মানুষ অমর হয়ে আছেন, তাঁদের মধ্যে এস. এম. সুলতান অন্যতম। তিনি শুধু একজন চিত্রশিল্পী নন, তিনি ছিলেন গ্রামীণ বাংলার প্রাণ ও কৃষক-শ্রমিক জীবনের প্রকৃত রূপকার। তাঁর ক্যানভাসে গ্রামবাংলার মাটি, কৃষকের ঘাম, মানুষের শ্রম আর প্রকৃতির মহিমা জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
জন্ম ও শৈশব
এস. এম. সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, নড়াইল জেলার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকার প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন। আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় খুব একটা অগ্রসর হতে না পারলেও শিল্পের প্রতি তাঁর টান কখনো কমেনি। কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেও নিয়মমাফিক শিক্ষা সম্পন্ন না করেই নিজের মতো করে শিল্প সাধনা চালিয়ে যান।
শিল্পকর্মের বৈশিষ্ট্য
সুলতানের চিত্রকর্মে বাংলার গ্রামীণ জীবন ছিল প্রধান অনুপ্রেরণা। তাঁর ছবিতে কৃষক ও কৃষাণীরা ছিলেন পেশীবহুল, দৃঢ়চেতা ও বীরত্বপূর্ণ। তিনি সাধারণ মানুষকে অসাধারণ শক্তির প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতেন।
কৃষক-শ্রমিককে তিনি দেখাতেন বাংলার আসল নায়ক হিসেবে।
তাঁর ছবিতে নারী-পুরুষ সমান শক্তিশালী এবং কর্মঠ।
প্রকৃতি, গাছপালা, নদী-নালা এবং গ্রামীণ সৌন্দর্য ছিল তাঁর শিল্পকর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
জীবনদর্শন ও ব্যক্তিত্ব
সুলতান সাধারণ জীবনযাপন পছন্দ করতেন। তিনি শিল্পী হয়েও ভোগ-বিলাস থেকে দূরে ছিলেন। নড়াইলের কেল্লারদিঘির পাড়ে তিনি শিশুদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন "শিশুস্বর্গ" নামক এক শিক্ষালয়, যেখানে শিশুদের মুক্তভাবে বেড়ে ওঠা ও সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ ছিল।
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
বাংলাদেশ সরকার তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে দিয়েছে—
একুশে পদক (১৯৮২)
স্বাধীনতা পদক (১৯৯৩)
এছাড়া বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে এবং প্রশংসিত হয়েছে।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তাঁর শিল্পকর্ম আজও বেঁচে আছে বাংলার কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রামী চিত্র হয়ে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন—বাংলার প্রাণ আসলে মাটির মানুষ, আর তাঁদের শ্রমই জাতির ভিত্তি।
উপসংহার
এস. এম. সুলতান শুধু একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলার কৃষিজীবন ও সংস্কৃতির এক অমর গায়ক। তাঁর আঁকা প্রতিটি ক্যানভাস বাংলার আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে থাকবে অনন্তকাল। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন—শিল্প মানেই শুধু সৌন্দর্য নয়, শিল্প মানেই মানুষের জীবন, শ্রম আর শক্তির মহিমান্বিত প্রকাশ।
No comments