ফেয়ার এন্ড লাভলী থেকে গ্লো এন্ড লাভলী: নাম বদলের পেছনের প্রকৃত কারণ ও অজানা ইতিহাস
দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে উপমহাদেশের মানুষের কাছে ফেয়ার এন্ড লাভলী ছিল একটি অত্যন্ত পরিচিত নাম। ছোটবেলা থেকে টিভি বিজ্ঞাপন, ম্যাগাজিন কিংবা দোকানের তাক—সবখানেই এই নামটি চোখে পড়ত। কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েক বছর আগে সবাই লক্ষ্য করলো, পরিচিত সেই ফেয়ার এন্ড লাভলী আর নেই; তার জায়গায় এসেছে গ্লো এন্ড লাভলী।
অনেকেই ভেবেছেন এটি হয়তো শুধুই মার্কেটিং কৌশল। কিন্তু বাস্তবে এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর সামাজিক পরিবর্তন, আন্তর্জাতিক বিতর্ক এবং কোম্পানির নীতিগত সিদ্ধান্ত। চলুন জেনে নিই পুরো ইতিহাস।
ফেয়ার এন্ড লাভলীর জন্ম ও জনপ্রিয়তা
১৯৭৫ সালে ইউনিলিভার (তৎকালীন হিন্দুস্তান লিভার লিমিটেড) প্রথম Fair & Lovely ক্রিম বাজারে আনে। দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া, ত্বকের রঙ এবং সৌন্দর্যবোধকে মাথায় রেখেই এই পণ্য তৈরি করা হয়।
বিজ্ঞাপনে বারবার একটি বার্তা দেওয়া হতো—
ফর্সা ত্বক মানেই সৌন্দর্য, আত্মবিশ্বাস ও সফলতা।
এই ধারণাই পণ্যটিকে দ্রুত জনপ্রিয় করে তোলে।
বিতর্কের শুরু: ত্বকের রঙ নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে Fair & Lovely নামটি নিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। বিশেষ করে—
“Fair” শব্দটি কি গায়ের রঙকে কেন্দ্র করে বৈষম্য তৈরি করছে?
ফর্সা হওয়াকে কি অতিরিক্তভাবে সৌন্দর্যের মানদণ্ড বানানো হচ্ছে?
শ্যামলা বা গাঢ় ত্বক কি পরোক্ষভাবে ‘অসুন্দর’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে?
এই প্রশ্নগুলো উঠে আসে গবেষক, মানবাধিকারকর্মী এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে।
Black Lives Matter আন্দোলনের প্রভাব
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হওয়া Black Lives Matter আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ত্বকের রঙভিত্তিক বৈষম্য নিয়ে নতুন করে আলোচনার জন্ম দেয়। এর প্রভাব পড়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর ওপরও।
ইউনিলিভার তখন ঘোষণা দেয়—
তারা এমন কোনো শব্দ বা ব্র্যান্ডিং ব্যবহার করবে না, যা গায়ের রঙ নিয়ে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে।
এরই ধারাবাহিকতায় Fair & Lovely নামটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম পরিবর্তন: Fair থেকে Glow কেন?
ইউনিলিভার ২০২০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে— Fair & Lovely → Glow & Lovely
এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল—
ত্বকের উজ্জ্বলতা ও স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া
রঙ নয়, বরং স্কিন কেয়ার ও গ্লো-এর ধারণা তুলে ধরা
সমাজে ইতিবাচক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বার্তা দেওয়া
“Glow” শব্দটি ত্বকের প্রাকৃতিক দীপ্তি বোঝায়, যা সব রঙের ত্বকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
শুধু নাম নয়, বিজ্ঞাপনেও পরিবর্তন
নাম বদলের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন কনসেপ্টেও বড় পরিবর্তন আনা হয়—
আগে:
ফর্সা হলেই চাকরি, বিয়ে, সাফল্য
আগে-পরের রঙের তুলনা
এখন:
আত্মবিশ্বাস
দক্ষতা ও যোগ্যতা
সব ধরনের ত্বকের সৌন্দর্যের স্বীকৃতি
অজানা একটি তথ্য
অনেকেই জানেন না, ইউনিলিভার এই নাম পরিবর্তনের আগে বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতিতে ভোক্তা জরিপ চালায়। সেখানে দেখা যায়—
নতুন প্রজন্ম ত্বকের রঙ নিয়ে আগের মতো চিন্তা করে না
তারা “ফেয়ারনেস” নয়, “হেলদি স্কিন” চায়
এই গবেষণাই সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত করে।
সমালোচনা কি পুরোপুরি থেমেছে?
না, পুরোপুরি নয়। কিছু সমালোচক বলেন—
নাম বদলালেও মূল পণ্যের ধারণা খুব একটা বদলায়নি
এটি অনেকটা “রি-ব্র্যান্ডিং”, গভীর সংস্কার নয়
তবে এটাও সত্য যে, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের পথে এটি একটি বড় পদক্ষেপ।
উপসংহার
ফেয়ার এন্ড লাভলী থেকে গ্লো এন্ড লাভলী—এই পরিবর্তন শুধুই একটি নাম বদল নয়। এটি সমাজের সৌন্দর্যবোধ, ত্বকের রঙ নিয়ে চিন্তাধারা এবং বৈশ্বিক সচেতনতার প্রতিফলন।
আজকের বিশ্বে সৌন্দর্য মানে শুধু রঙ নয়, বরং
👉 সুস্থতা
👉 আত্মবিশ্বাস
👉 নিজেকে যেমন আছি তেমনভাবে গ্রহণ করা
আর এই বার্তাই ইউনিলিভার তাদের নতুন নামের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেয়েছে।


No comments