করলা গাছের পাতা লাল হয়ে যাওয়া ও ফলন কমার কারণ—সমাধান, সার ব্যবস্থাপনা ও সঠিক সময়

 



করলা বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় সবজি। তবে অনেক সময় দেখা যায়—করলা গাছের পাতা লাল হয়ে যাচ্ছে, গাছের বৃদ্ধি কমে যাচ্ছে এবং ফলনও কমে যাচ্ছে। এসব সমস্যার মূল কারণ বুঝতে পারলে সহজেই প্রতিকার করা যায়। নিচে ধাপে ধাপে বিশদ আলোচনা করা হলো।


 করলা গাছের পাতা লাল হয়ে যাওয়ার মূল কারণ 

১. পুষ্টির অভাব (ফসফরাসের ঘাটতি)

পাতা লাল বা লালচে-বেগুনি হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ফসফরাসের ঘাটতি। এই পুষ্টি মূল গঠন, ফুল ও ফল ধরতে গুরুত্বপূর্ণ।

লক্ষণ:

পাতার নিচের দিক লাল

পুরনো পাতায় বেশি সমস্যা

গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত

২. ঠান্ডা বা অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত সমস্যা

শীত বেশি হলে গাছ ফসফরাস শোষণ করতে পারে না, তখন পাতায় লাল ভাব দেখা দেয়। আবার প্রচণ্ড গরমেও ক্লোরোফিল নষ্ট হয়ে লাল-বাদামী দাগ দেখা দিতে পারে।

৩. মাটির অম্লতা (pH সমস্যা)

মাটির pH যদি ৫-এর নিচে বা ৭.৫-এর উপরে হয়, গাছ পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে না।

৪. রোগ-পোকামাকড় আক্রমণ

ডাউনি মিলডিউ রোগে পাতায় লালচে-বাদামী দাগ দেখা যায়।

এফিড/মাইটা পোকায় পাতা রঙ বদলে কুঁকড়ে যেতে পারে।


করলা গাছের ফলন কম হওয়ার কারণ

১. সার ব্যবস্থাপনার ভুল

অতিরিক্ত নাইট্রোজেন দিলে গাছ শুধু লতা-পাতা বাড়ে কিন্তু ফলন কমে যায়।

২. ফুল ঝরে পড়া

পরাগায়ন কম হলে স্ত্রী-ফুল ঝরে যায় ও ফল ধরে না।

৩. পানি ব্যবস্থাপনার অসামঞ্জস্য

অতিরিক্ত পানি শিকড় নষ্ট করে, আবার পানির অভাবেও ফল ছোট হয়।

৪. রোগ-পোকা আক্রমণ

ফলমাছি, এফিড, ডাউনি মিলডিউ—সবই ফলন কমায়।


সঠিক সার ব্যবস্থাপনা

মাটির প্রস্তুতি (রোপণের আগে)

একটি বীজতলা/গর্ত তৈরির সময় নিচের মতো সার মিশানো ভালো:

পচা গোবর/কম্পোস্ট: ৫–৭ কেজি

টিএসপি (ফসফেট): ২৫–৩০ গ্রাম

এমওপি (পটাশ): ২০–২৫ গ্রাম

ডলোমাইট/চুন: প্রয়োজনে ২০–৩০ গ্রাম (pH ঠিক রাখতে)

গাছ লাগানোর পর সার প্রয়োগ (টপ ড্রেসিং)

১৫–২০ দিন পর প্রথম সার

ইউরিয়া: ১০–১৫ গ্রাম

এমওপি: ১০–১৫ গ্রাম

জিঙ্ক সালফেট (প্রয়োজনে): ২–৩ গ্রাম

৩৫–৪০ দিন পর দ্বিতীয় সার

ইউরিয়া: ১০–১২ গ্রাম

এমওপি: ১৫ গ্রাম

বোরিক অ্যাসিড (ফল ধরে ভাল রাখতে): ১ গ্রাম/লিটার পানিতে স্প্রে

ফল ধরার সময় তৃতীয় সার (৬০ দিন পর)

এমওপি: ১৫–২০ গ্রাম

তরল জৈব সার/জলসেচে গোবরের ঘোল ব্যবহার করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।

 পাতা লাল হওয়া ও ফলন কমার সমাধান. 

১. ফসফরাস ঘাটতি পূরণ

পাতা লাল হলে:

টিএসপি সরাসরি মাটিতে ব্যবহার: প্রতি গাছে ২০ গ্রাম

অথবা

ডিএপি মাটি ভিজিয়ে ১৫ গ্রাম দিতে পারেন।

পাতায় স্প্রে করার জন্য (দ্রুত ফল)

১০ লিটার পানিতে ২০০ গ্রাম সুপার ফসফেট ভিজিয়ে ১২ ঘণ্টা রাখুন

পরিষ্কার অংশ ছেঁকে পাতায় স্প্রে করুন

এটি দ্রুত কাজ করে।


২. রোগ-পোকা প্রতিকার

এফিড/মাইট হলে: ৫ মিলি নিম তেল + ১ লিটার পানি স্প্রে

ডাউনি মিলডিউ:

২ গ্রাম ম্যানকোজেব + ১ লিটার পানি

সপ্তাহে ১ বার


৩. পানি ব্যবস্থাপনা

অতিরিক্ত পানি জমতে দেবেন না

শুষ্ক হলে সপ্তাহে ২–৩ বার সেচ দিন

গাছের গোড়া খোলা রাখবেন কিন্তু পানি ঢুকবে এমন নয়



৪. পরাগায়ন বৃদ্ধি (ফলন বাড়াতে)

সকালে ৮–১১টার মধ্যে পুরুষ ফুলের পরাগ স্ত্রী ফুলে ছুঁইয়ে দিন

মৌমাছি আকৃষ্ট করতে আশেপাশে ফুলের গাছ রাখুন

অতিরিক্ত টিপস – বেশি ফল পাওয়ার জন্য

ঝোপ বেশি হলে অনাবশ্যক লতা ছেঁটে দিন

খুঁটি বা মাচা দিয়ে লতা ওপরে তুলুন

প্রতি ১০–১২ দিন পর নিম-তেল স্প্রে করুন (রোগ প্রতিরোধ)



উপসংহার

করলা গাছের পাতা লাল হওয়া প্রধানত পুষ্টির ঘাটতি, আবহাওয়া বা রোগের কারণে হয়। সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণে সার প্রয়োগ করলে গাছ সুস্থ থাকে এবং ফলনও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। নিয়মিত পরিচর্যা, পানি নিয়ন্ত্রণ, রোগ-পোকা ব্যবস্থাপনা এবং পরাগায়নে সহায়তা করলে করলার ফলন অনেক ভালো হয়।

No comments

Powered by Blogger.